সমস্ত শরীরে ভীষণ ব্যথা, মনে হয় যেন সমস্ত শরীর চূর্ন বিচুর্ণ হয়ে গিয়েছে, পিঠে, মাথায়, বুকে, হাতে-পায়ে ও কব্জিতে ব্যথা। |
হাড়ের ভিতর এমন ব্যথা যেন ভেঙ্গে গেছে, বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা জ্বরের সময়। |
অত্যন্ত পিপাসার্ত, ঠাণ্ডা পানীয় পানের প্রবল আকাঙ্ক্ষা কিন্তু পান করলে পিত বমি করে। |
টাটানি, মাথাব্যথার সহিত টাটানি। |
মাথা ব্যথা ছাড়া সকল সমস্যা ঘর্ম হলে উপশম। |
উপযোগিতা – বয়স্ক লোকেদের অসুখে, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে বিশেষতঃ যারা, অমিতাচারে অভ্যস্থ তাদের অসুখে, বারে বারে ও অনেকদিন ধরে পৈত্তিক ও সবিরাম জ্বরে যাদের ধাতু বিকৃতি হয়ে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে উপযোগী।
সারাদেহে থেঁৎলে যাওয়া মত ব্যথা যেন হাড়গোড় ভেঙ্গে গেছে (আর্নিকা, বেলিস-পেরেনিস, পাইরো)। হাড়ে ব্যথা, পিঠে, মাথা, বুক, হাত পা বিশেষতঃ হাতের কজির যেন জোড় ভেঙ্গে গেছে এমন ব্যথা, বেদনা যতই সর্বাঙ্গে হয় ও বেশী হয় ততই এ ওষুধ কার্যকরী হয় (তুলনীয় = ব্রায়ো, মার্ক)।
সারা চোখে ব্যথা যেন ঘা হয়েছে, সর্দি, সব হাড়ে ব্যথা যেন কামড়াচ্ছে, এপিডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে অত্যন্ত অবসন্নতা (ল্যাক-ক্যান)।
*ব্যথা বেদনা যতটা এ দ্রুত আসে আবার তেমনি দ্রুত চলে যায় (বেল, ম্যাগ-ফস, ইউপে-পার্পিউ)।
মাথাঘোরা — মনে হয় বাদিকে পড়ে যাচ্ছে (পড়ে যাবার ভয়ে বাঁদিকে মাথা ঘোরায় না = কলোসিন্থ)।
কাশি — অনেক দিনের, তরল কাশি ঐ সাথে হেকটিক জ্বর, বুকে ঘা এর মত ব্যথা কাশলে অবশ্যই বুক হাত দিয়ে চেপে ধরে (ব্রায়ো, নেট-কা); কাশি রাতে বাড়ে; হাম হওয়ার পর বা সবিরাম জ্বর চাপা পড়ে কাশি, সেক্ষেত্রেও উপযোগী।
জ্বর — একদিন সকাল ৭টায় পরদিন দুপুরে আসে। শীত অবস্থার পর তিক্ত বমি হয়। জলপানে শীত ভাবে বাড়ে ও বমি হতে থাকে। শীতভাবের আগেও ঐ সময় হাড়ে যন্ত্রণা হয়।
শীতভাবের আগে জ্বরের শীত অবস্থায় ও জ্বরভোগ কালে অদম্য তৃষ্ণা, যখন বেশী জল খেতে পারে না তখন জ্বর আসছে বুঝতে পারে।
সম্বন্ধ — এরপর নেট-মি ও সিপিয়া ভাল কাজ করে।
তুলনীয় — জন্ডিস লক্ষণে চেলিডো, পডো, লাইকোর সদৃশ। ব্রায়োনিয়া এর অত্যন্ত কাছের ওষুধ—তাতে প্রচুর ঘাম হয় কিন্তু ব্যথায় রোগী চুপ করে পড়ে থাকে এদিকে ইউপেটো-তে ঘাম সামান্যই হয় অথচ রোগী ব্যথায় অস্থির হয়ে পড়ে ।
শক্তি – ৩, ৬, ৩০ ।
এই ঔষধটি “বোন-সেট” বা হাড়জোড়া নামে পরিচিত। কারণ এই ঔষধটি খুব সহজেও অতিদ্রুত, কিছুজ্বর জাতীয় রোগ যথা ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি ক্ষেত্রে থাকা অস্থি ও পেশীর বেদনার উপশম করে থাকে। ইউপেটোরিয়াম মূলতঃ পাকাশয় ও যকৃৎ সংক্রান্ত যন্ত্রসমূহ ও বায়ুনলীর শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর উপর কাজ করে। জলা-জঙ্গল প্রভৃতি এলাকার কাছে এটি একটি বর বিশেষ এবং যে সকল অবস্থায় অস্থিবেদনা প্রকাশ পায়। সেই সব ক্ষেত্রেও এটি একটি বর বিশেষ। পুরাতন পিত্তাধিক্যজনিত সবিরাম জ্বরের জন্য ঋতুবকৃতি। মদ্যপান জনিত ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্য। সকল যন্ত্র ও সকল প্রকার কাজের শিথিলতা। সর্বাঙ্গীন ও তীব্র; অস্থিবেদনা, টাটানি ব্যথা। নির্দিষ্ট সময় পর পর রোগ প্রকাশ পায়, এই লক্ষণটি সুস্পষ্টভাবে থাকে (আর্সেনিক, চায়না, সিড্রন)।
মাথা — দপদপকর বেদনা। মাথায় চাপবোধ, যেন মনে হয় একটি সিলভার টুপী দ্বারা সমগ্র মাথায় চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাথা ঘোরা, বাম দিকে পড়ে যাবে এই জাতীয় অনুভূতি। পিত্তবমন। মাথার তালু ও পিছনে বেদনা ও চোখের তারায় টাটানি ব্যথা। নির্দিষ্ট সময় পর পর মাথার বেদনা, বেদনা প্রতি তিনদিন ও সাতদিন পর পর দেখা দেয়। শুয়ে পড়ার পরে মাথার পিছনের অংশে বেদনা তৎসহ মাথায় ভারবোধ।
মুখগহ্বর — মুখ গহ্বরের কোনগুলি ফাটা, হলুদ লেপ যুক্ত জিহ্বা, পিপাসা।
পাকস্থলী – জিহ্বা হলুদ। মুখের আস্বাদ তিতো। যকৃৎ প্রদেশে টাটানি ব্যথা। প্রচুর পিপাসা। পিত্ত বমন ও বাহ্যি, এটি সবুজ রঙের তরল পদার্থ, প্রতিবার কয়েক লিটার করে বেরিয়ে যায়। বমির আগে পিপাসা। হিক্কা। (সালফিউরিক অ্যাসিড), হাইড্রোসাইয়েনিক অ্যাসিড)। কষা জামা কাপড় পরিহার করে।
মল — বারে বারে সবুজ, জলের মত। খিলধরা, কোষ্টকাঠিণ্য, তৎসহ যকৃতে টাটানি।
শ্বাস-প্রশ্বাস – সর্দি তৎসহ, হাঁচি, স্বরঙ্গ ও কাশি, তৎসহ বুকে টাটানি ব্যথা; কাশির সময় বুকে হাত দিয়ে কাশে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, তৎসহ পেশী ও অস্থি সমূহে প্রচন্ড টাটানি ব্যথা। পুরাতন তরল কাশি, বুকে টাটানি ব্যথা; রাত্রে বৃদ্ধি, হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকলে কাশির উপশম।
জ্বর — ঘামে সকল কষ্টের উপশম কেবলমাত্র মাথার যন্ত্রনা ছাড়া। শীত সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে শুরু হয়। শীতের পূর্বে পিপাসা তত্সহ পেশী ও অস্থিসমূহের টাটানি ব্যথা ও প্রচন্ড কনকনানি। বমি বমি ভাব, শীতাবস্থা বা উত্তাপ অবস্থার শেষাবস্থায় পিত্তবমন; দপদপ কর মাথার যন্ত্রনা। রোগী বুঝতে পারে এই বার তার শীত করা শুরু হবে, কারণ এই সময় সে যথেষ্ট পরিমাণে জল পান করতে পারে না।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ – পিঠে কনকনানি বেদনা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্থিতে কনকনানি তৎসহ পেশীসমূহের টাটানি। বাহু ও কজিতে কনকনানি। বামপায়ে বুড়ো আঙ্গুলের স্ফীতি। গেঁটেবাতের মত টাটানি ও সন্ধিস্থানে অস্থিগুটি সমূহের প্রদাহ, তৎসহ মাথার বেদনা। শোথ যুক্ত স্ফীতি।
কমা-বাড়া-বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট সময় পর পর।
উপশম, আলাপ-আলোচনায়, হামাগুড়ি দিয়ে থাকলে,
সম্বন্ধ-তুলনীয়- ব্রায়োনিয়া, সিপিয়া, স্ট্রোম মিউর; চেলিডোনিয়াম; নিক্ট্যান্থেস্ আর্বর-ট্রিষ্টিস (পিত্তাধিক্যজনিত জ্বর; অতৃপ্তকর পিপাসা; শীতাবস্থার, শেষাবস্থায় তিতো বমি, এছাড়াও শিশুদের কোষ্ঠকাঠিণ্য।)
শক্তি – অরিষ্ট্য থেকে ৩য় শক্তি।
যতবারই আমি এই সব পারিবারিক ঔষধগুলির কোনটির সম্বন্ধে আলোচনা করি, ততবারই পারিবারিক ব্যবহার হইতে যে-সকল ঔষধিগুণের আবিষ্কার হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইয়া পড়ি। সমগ্র পূর্বাঞ্চলে, পল্লীগ্রামে, প্রাথমিক ঔপনিবেশিকদিগের মধ্যে সর্দির জন্য এই Boneset গাছের চা ঔষধরূপে ব্যবহৃত হইত। প্রত্যেকটি শিরঃশ্লেষ্মায়, নাসিকার সর্দিস্রাবে, প্রত্যেক প্রকার অস্থিবেদনায় অথবা প্রবল জ্বরে অথবা ঠান্ডা লাগার ফলে শিরঃপীড়ায়, বৃদ্ধা গৃহিণীরা তাহাদের Boneset চা তৈয়ারী রাখিতেন। নিশ্চয়ই উহাতে যেরূপ ফল হইত, পরীক্ষা দ্বারাও তাহাই প্রমাণিত হইয়াছে। সুস্থ ব্যক্তিগণের উপর পরীক্ষা Boeneset সেরূপ লক্ষণ প্রকাশ করিয়াছে, তাহা বৃদ্ধ কৃষকেরা যেরূপ সর্দিতে কষ্ট পায় তাহার অনুরূপ।
পূর্বদিকের রাজ্যগুলিতে এবং উত্তর অঞ্চলে শীতকালীন সাধারণ সর্দির সহিত অত্যধিক হাঁচি ও সর্দিস্রাব, বিদীর্ণকর ও সঞ্চালনে বৃদ্ধিযুক্ত শিরঃপীড়া, গরম বস্ত্রাদিতে আবৃত থাকিবার ইচ্ছার সহিত শীত-শীতবোধ, হাড়গুলি যেন ভাঙ্গিয়া যাইবে—এরূপ অস্থিবেদনা, জ্বর, তৃষ্ণা এবং সঞ্চালনে বৃদ্ধি-লক্ষণ থাকে। এইরূপ প্রাত্যহিক সর্দিতে, সময়ে সময়ে ইউপেটোরিয়াম এবং সময়ে সময়ে ব্রায়োনিয়া প্রয়োজন হয়। এই দুইটি ঔষধ অত্যন্ত সদৃশ, কিন্তু হাড়ের মধ্যে কামড়ানি ইউপেটোরিয়ামেই সুস্পষ্ট। যদি এই অবস্থা কয়েকদিন চলিতে থাকে, তাহা হইলে রোগী হলদে হইয়া পড়ে, তাহার বুকে সর্দি বসে, হয়ত নিউমোনিয়া দেখা দেয়, অথবা যকৃৎপ্রদাহ উপস্থিত হয় অথবা সচরাচর যাহাকে পৈত্তিক জ্বর বলে, তদ্রুপ জ্বরের আক্রমণ হয়। এইরূপ জ্বরে সচরাচর ব্রায়োনিয়া এবং ইউপেটোরিয়াম নিজ নিজ অধিকারে উপযোগী হইয়া থাকে। উষ্ণ আবহাওয়ায় প্রায়ই এরূপ সর্দি হয় না, কিন্তু ইউপেটোরিয়াম উষ্ণ অঞ্চলের জ্বরে, পীতজ্বরে, পৈত্তিকজ্বরে, হাড়ভাঙ্গা জ্বরে এবং সবিরাম জ্বরেও প্রযোজ্য হইয়া থাকে। ইহা এক প্রকার আবহাওয়ায় এক প্রকার রোগে এবং অপরপ্রকার আবহাওয়ায় অন্যপ্রকার রোগে উপযোগী বলিয়া মনে হয়।
পিঠ হইতে বিস্তারশীল, মাথা হইতে পা পর্যন্ত কম্প, ঠান্ডায় অত্যনুভূতি, রক্তসঞ্চয়যুক্ত শিরঃপীড়া, আরক্তিম মুখমন্ডল, হলদে চৰ্ম্ম এবং হলদে চক্ষু, উদরে ও যকৃপ্রদেশে যন্ত্রণা, কোন খাদ্য পেটে রাখিতে অক্ষমতা, খাদ্যের দৃশ্য বা গন্ধে বমি বমিভাব; হাড়গুলি যেন ভাঙ্গিয়া যাইবে, এরূপ কনকনানি, খুব বেশী জ্বর, মেহগ্নি কাঠের বর্ণ মূত্র, জিহ্বায় পুরু হলদে লেপ এবং বমি বমিভাব ও পিত্ত বমন। আহারের পর পাকস্থলীতে যন্ত্রণা এবং খাদ্যের চিন্তায় ও গন্ধে। বমনেচ্ছা। পাকস্থলী অত্যন্ত উপদাহযুক্ত থাকে, খাদ্যের চিন্তায় তাহার মুখরোধ হয়। রোগী স্থির থাকিতে চায়, কিন্তু যন্ত্রণা এত গুরুতর হয় যে, সে নড়াচড়া করিতে বাধ্য হয়, এবং এইজন্য তাহাকে স্থির দেখায়। তরুণ রোগ বিকাশের মধ্যে এই লক্ষগুলি পাওয়া যায় এবং এগুলি কেবলমাত্র সাধারণ লক্ষণ এবং রোগীর মধ্যে এইগুলি আছে কিনা, আমাদিগকে তাহা লক্ষ্য করিতে হইবে।
সবিরাম জ্বর বহু ব্যাপক আকার ধারণ করিলে, ইউপেটোরিয়াম বিশেষ উপযোগী হইয়াছে। প্রথম লক্ষণগুলির মধ্যে জ্বরাক্রমণের কিছু পূৰ্ব্বে হইতে বমিবমি ভাব থাকে এবং অনেক সময়ে পিত্ত বমনের আবেশ উপস্থিত হয়। পূর্বাহ্নে ৭টা বা ৯টার কাছাকাছি সে কাপিতে আরম্ভ করে, কম্পন পৃষ্ঠ দিয়া নামিতে থাকে; এবং পৃষ্ঠ হইতে হস্ত-পদাদি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তাহার ভীষণ তৃষ্ণা থাকে কিন্তু জলপানে কম্পের বৃদ্ধি হয়, এইজন্য সে ঠান্ডা জল পান করিতে সাহস করে না। মাথার পশ্চাদ্দিকে ক্ষততা ও দপদপানি থাকে, শীতের পূৰ্ব্বে ও সময়ে মস্তকের পশ্চাদ্দিকে ও পৃষ্ঠে ভীষণ যন্ত্রণা। শীতের সময় সে আবৃত থাকিতে চায় এবং তাহার গায়ে গাদা করিয়া কাপড় চাপাইতে হয়। জ্বরের সব অবস্থাতেই তৃষ্ণা থাকে। শীতের নিবৃত্তির পর বমন দেখা দেয়, সচরাচর উত্তাপ দেখা না দেওয়া পর্যন্ত বমন হয় না, কিন্তু ভালরূপে ঘর্ম আরম্ভ হওয়ার পূৰ্ব্বে সে প্রচুর বমি করে, প্রথমে পাকস্থলীর আধেয় এবং তারপর পিত্ত। যখন উত্তাপ চলিতে থাকে; মনে হয় তাহার সর্বাঙ্গ যেন পুড়িয়া যাইতেছে, সময়ে সময়ে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় মনে হয়। তীব্র, উত্তাপ, মস্তক-শীর্ষে জ্বালা, তাহার পদদ্বয় জ্বালা করে, গায়ে জ্বালা করে। উত্তাপ দেখিয়া যেরূপ মনে হয়, তাহা অপেক্ষা বেশী জ্বালা করে। ঘাম কম হওয়াই এই ঔষধটির প্রকৃতি; প্রবল শীত, তীব্র জ্বর, উহা ধীরে ধীরে চলিয়া যায় এবং সামান্য ঘাম হয়। শীতের সময় তাহার মাথা যেন ফাটিয়া যাইবে এরূপ ব্যথা করে, উহা দপদপ করে, উহা যেন ছিঁড়িয়া যাইতে থাকে, উহাতে যেন হুল ফুটিতে থাকে, উহাতে জ্বালা করে, রোগী তীব্রতাজ্ঞাপক শব্দ দ্বারা এই শিরঃপীড়ার বর্ণনা করে, সম্ভবতঃ ইহা যেন রক্তসঞ্চয়জনিত শিরঃপীড়া। লোকে মনে করে, যে জ্বর কমিয়া গেলে এবং রোগীর একটু একটু ঘৰ্ম্ম দেখা দিলে তাহার উপশম হইবে, বাস্তবিক তাহা হয়ও, কিন্তু শিরঃপীড়ার উপশম হয় না; উহা রোগাক্রমণের শেষ পর্যন্ত ক্রমেই বাড়িতে থাকে এবং সময়ে সময়ে সমস্ত দিন ও সমস্ত রাত্রি থাকিয়া যায় তারপরের দিনটি সে শিরঃপীড়া হইতে মুক্ত থাকে, কিন্তু তৃতীয় দিনে ৭টা বা ৯টার সময় সেই পূৰ্ব্বেকার যন্ত্রণাই আরও তীব্রভাবে উপস্থিত হয়। সময়ে সময়ে এইসব আক্রমণ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়, একটি আক্রমণ অপরটি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, অর্থাৎ রোগটি একপ্রকার স্বল্পবিরাম জ্বরের প্রকৃতি গ্রহণ করে, কখনও সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ হয় না। যত দীর্ঘকাল এইরূপ চলিতে থাকে, যকৃত তত বেশী রক্তপূর্ণ হইয়া উঠে এবং অবশেষে মূত্র অত্যন্ত পিত্তে পূর্ণ হইয়া পড়ে, মল সাদাটে হয়, জ্বর বাড়ে, বমিবমি ভাব বাড়ে, জিহ্বা সূক্ষ্মাগ্র ও লম্বা হইয়া যায় এবং শুষ্ক থাকে, শিরঃপীড়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং একপ্রকার প্রচ্ছন্ন জ্বরের অবস্থা উপস্থিত হয়।
যে-সকল সবিরাম জ্বর ভয়ানক কম্পের সহিত আরম্ভ হয় এবং ঘাম ব্যতীত শিরঃপীড়া চলিতে থাকে অথবা যদি ঘাম হয়, তাহা হইলে শিরঃপীড়া আরও খারাপ হইয়া পড়ে, সকল অবস্থায় তৃষ্ণা থাকে, উত্তাপের শেষে ও উত্তাপের সময় পিত্ত বমন থামে, ঐসঙ্গে ভয়ঙ্কর অস্থিবেদনা থাকে, তাহাতে মেটিরিয়া মেডিকা পাঠে অভ্যস্থ পশ্চিম অঞ্চলের লোকেরা জানেন যে, ইউপেটোরিয়াম নিশ্চয় আরোগ্যকর ঔষধ। জ্বরের প্রাবল্যের শেষে ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়। প্রতিক্রিয়া যখন খুব ভাল হয় অর্থাৎ যখন প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে এবং জ্বরের আবেশ চলিয়া গিয়াছে, তখনই তোমরা ঔষধ দ্বারা সর্বোৎকৃষ্ট ফল পাইবে। এই কথা পৰ্য্যায়শীলতাযুক্ত সব রোগের পক্ষেই সত্য, অপেক্ষা করা সম্ভব হইলে, আক্রমণের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে। তোমরা ঐরূপ রোগকে আক্রমণের সময় খুব বেশী কমাইয়া আনিতে পারিবে না, যদি তখন ঔষধ দেওয়া হয়। খুব সচরাচর উহাতে কষ্ট বাড়িয়া যায়, কিন্তু তোমরা যদি আক্রমণের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর, তাহা হইলে ঔষধ দ্বারা পূর্ণ উপকার পাইবে, পরবর্তী আক্রমণটি আসিবে না অথবা অনেক কম হইবে অথবা যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একবার আক্রমণ হয়, তাহা হইলেও নিশ্চিত জানিবে যে, আর রোগাক্রমণ হইবে না। সবিরাম জ্বরে জ্বরাক্রমণের শেষে ঔষধটি প্রয়োগ করা হইয়া থাকিলে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দ্বিতীয়বার জ্বরাবেশ হওয়া অদ্ভুত কিছু নহে, এইপ্রকার মিশ্রিত রোগগুলি সচরাচর বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকে। যাহারা একথা জানে না, তাহারা ভীরুতার চিহ্ন প্রদর্শন করে। ভীত হয় এবং মনে করে যে রোগী খারাপ হইয়া যাইতেছে, কিন্তু তোমাদিগকে কেবলমাত্র রোগাক্রমণ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে এবং তারপর দেখিবে যে, তোমরা উহার আবর্তন ও পৰ্য্যায়শীলতা ভাঙ্গিয়া দিয়াছ।
যখন এই ঔষধটি সবিরাম জ্বরে দৃশ্যতঃ নির্দিষ্ট হইয়াও সবিরাম জ্বরটির মূলোৎপাটন করিবার মত যথেষ্ট গভীরভাবে কার্যকর বলিয়া প্রমাণিত হয় না, তখন আমাদের দুইটি ঔষধ আছে এবং উহাদের মধ্যে যে-কোন একটি কাজে আসে,“উহারা ‘নেট্রাম মিউর’ ও ‘সিপিয়া। এই দুইটি ঔষধ ইউপেটোরিয়ামের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, এবং লক্ষণ মিলিলে, যেখানে ইউপেটোরিয়ামের ক্রিয়া শেষ হয়, সেইখান হইতে ইহাদের ক্রিয়া আরম্ভ হয়।
এই ঔষধে একপ্রকার পুরাতন ধাতুগত অবস্থা আছে, উহা ইহার বাত প্রকৃতি। ইহা গেঁটেবাতে একটি বিশেষ উপযোগী ঔষধ। ইহাতে গেঁটেবাতজনিত বেদনা, এবং অঙ্গুলিসন্ধিগুলিতে, কনুইসন্ধিতে ঢিবলি জন্মায়, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে যন্ত্রণা ও গেঁটেবাতজনিত স্ফীতি, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সন্ধির লালবর্ণ স্ফীতি আছে। যে সকল লোকের হস্তাঙ্গুলের গাঁটেগাঁটে চকপাথরবৎ সঞ্চয় জন্মে, ইহা তাহাদিগকে আরোগ্য করে। এইরূপ গেঁটেবাতগ্রস্ত রোগীর সর্দি লাগে, হাড় কনকন করে, সন্ধিগুলি প্রদাহিত হয়, রোগী বলে, সে শীত বোধ করে, চর্ম হলদে হইয়া যায়, মূত্র পিত্ত মিশ্রিত হয়, মল সাদাটে হয় এবং সে দুৰ্বল হইয়া পড়ে। অনেকস্থলে এই সকল রোগী, গেঁটেবাতবিশিষ্ট সন্ধি এবং দুর্বলতার উপশমের জন্য, তাহারা বহু বৎসর ধরিয়া বার্গান্ডি মদের আশ্রয় হইয়া থাকেন। আমাদের হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলির কোন কোনটি যন্ত্রণার উপশম দিতে পারে, কিন্তু যে-সকল গেঁটেবাত রোগী সৰ্ব্বদাই মদ্যপান করে, তোমরা তাহাদিগকে সহসা মদ্য ছাড়াইতে পারিবে না এবং তাহারা মদ্যপানে অভ্যস্ত থাকে বলিয়া তাহাদের আক্রমণ চলিতেই থাকে, তোমরা উপশম দিতে পার না। গেঁটেবাতগ্রস্ত ব্যক্তিরা সচরাচর বার্গান্ডি নামক মদ খুবই ব্যবহার করে, কিন্তু স্কটল্যান্ডের লোক গেঁটেবাত হইলে ভাবে যে, তাহাকে সর্বদা একটু একটু হুইস্কি পান করিতে হইবে এবং রোগাক্রমণের সময় তাহাকে উহা ছাড়ান অসম্ভব হইয়া উঠে। তাহার যে অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, তাহা কিছুদিন চলিতে দেওয়াই ভাল, কারণ তাহা না হইলে সে আরও দুৰ্বল হইয়া পড়িবে, কিন্তু তথাপি উহা তাহার ক্ষতি করে, এইজন্য যে-সকল গেঁটেবাতগ্রস্ত রোগী মদ্যজাতীয় উত্তেজক দ্রব্য পান করে, তাহাদিগকে আরোগ্য করা কঠিন ব্যাপার হয়। তুমি হোমিওপ্যাথির পূর্ণ ফল পাইবে না, কারণ তুমি তাহার উত্তেজক দ্রব্য পান করা বন্ধ করিতে পারিবে না, কারণ তাহা হইলে তাহার দুর্বলতা উপস্থিত হইবে। যে-সকল লোক পানীয় দ্রব্য হিসাবে নিয়মিতভাবে মদ্যপান করেন না, তাহারা উহা ত্যাগ করিতে পারেন এবং তাহাই করা উচিত, কারণ উহা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ক্রিয়ায় বাধা দেয়।
এই সকল গেঁটেবাত রোগীর ভীষণ সবমন শিরঃপীড়া হয়। গেঁটেবাতবিশিষ্ট সন্ধিগুলির সহিত মস্তিষ্কের তলদেশে এবং মস্তকের পিছনে বেদনা অনুভূত হয়। ইহাকে সচরাচর গ্রন্থিবাতজ শিরঃপীড়া অর্থাৎ গেঁটেবাতের শিরঃপীড়া, যন্ত্রণাযুক্ত সন্ধির সহিত সংশ্লিষ্ট শিরঃপীড়া বলিয়া উল্লেখ করা হয়। আবার শিরঃপীড়া সন্ধির যন্ত্রণার সহিত পৰ্য্যায়ক্রমেও উপস্থিত হইতে পারে রক্তসঞ্চয়জনিত শিরঃপীড়া, যন্ত্রণা মস্তিষ্কের তলদেশে, তৎসহ অল্পবিস্তর দপদপানি থাকে, বেদনা মাথার মধ্য দিয়া উপরদিকে বিস্তৃত হয় এবং সর্বাঙ্গীণ রক্তসঞ্চয়ের ন্যায় অবস্থার সৃষ্টি করে। সন্ধিগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল থাকিলে সময়ে সময়ে শিরঃপীড়া উপস্থিত হয়, এবং শিরঃপীড়া যত বেশী হয়, হস্তপদাদির যন্ত্রণাও ততই কম হইতে থাকে, আবার যখন গেঁটেবাত হস্ত-পদাদিকে আক্রমণ করে, তখনই শিরঃপীড়া কমিয়া যায়। শিরঃপীড়া প্রতি তৃতীয় বা সপ্তমদিনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এবং অল্পাধিক পৰ্যায়শীলতার সহিত দেখা দেয়। শিরঃপীড়ার সহিত বমনেচ্ছা ও পিত্তবমন থাকে, এবং খাদ্যের চিন্তায় ও গন্ধে গা বমিবমি করে। এইরূপ গেঁটেবাতের রোগীদের শিরোঘূর্ণন থাকে এবং শিরোবেদনা দেখা দিলে, সে যেন বামদিকে পড়িয়া যাইবে, এরূপ অনুভূত হয়। শিরোঘূর্ণন প্রাতঃকালে উপস্থিত হয়, যখন সে নিদ্রা হইতে উঠে, তাহার মনে হয়, যেন সে বামদিকে পড়িয়া যাইবে এবং সেইজন্য বামদিকে ঘুরিয়া, তাহাকে সামলাইয়া লইতে হয়। সময়ে সময়ে সবিরাম জ্বরে, এইরূপ বামদিকে হেলিয়া পড়া, বমনেচ্ছা ও বমনে পরিসমাপ্ত শিরোঘূর্ণন, মাথার পশ্চাদ্দিকে ভীষণ যন্ত্রণা এবং হাড়ে যন্ত্রণা, প্রাথমিক আক্রমণ-সূচক-লক্ষণ হইয়া থাকে।
আমরা এই ঔষধে অন্যপ্রকার গেঁটেবাতের বিকাশও পাইয়া থাকি, শঙ্খস্থানে তীরবিদ্ধবৎ যন্ত্রণা, মাথার বামপার্শ্ব হইতে ডানপার্শ্ব পর্যন্ত তীরবিদ্ধবৎ যন্ত্রণা, সমস্ত মাথার মধ্যে তীরবিদ্ধবৎ যন্ত্রণা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সূচীবিদ্ধবৎ, ছিন্নকর বেদনা,অস্থিতেও কামড়ানি। শিরঃপীড়া এত ভীষণ, তাহার পাকস্থলীতে বমি বমিভাব উপস্থিত হয়। ঐ সবিরাম জ্বরের প্রবল উত্তাপের অবসানে, গেঁটেবাতজনিত শিরঃপীড়ার এবং নির্দিষ্টকাল ব্যবধানে আগত শিরঃপীড়ার প্রকৃতি এইরূপ হয়, যন্ত্রণা এত তীব্র হয় যে, শীঘ্রই বমনেচ্ছা উপস্থিত হয় এবং তারপর সে পিত্ত বমি করিতে আরম্ভ করে। বাত অবস্থায় লক্ষণ সাদৃশ্যে ইউপেটোরিয়াম যেরূপ সচরাচর ব্যবহৃত হওয়া উচিত, তদ্রূপ ব্যবহৃত হয় নাই। সবিরাম জ্বরে ইহা সুপরিচিত, শিরঃপীড়ায় মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়। শিরঃপীড়ায় এবং স্বল্পবিরাম জ্বরে কেবলমাত্র মাঝে মাঝে লোকে ইহার মহৎ উপকারিতা উপলব্ধি করে। গেঁটেবাত ও বাতরোগে ইহা লক্ষণসদৃশ হইতে পারে এবং লোকে যতটা জানে, ইহা তাহা অপেক্ষা বেশী উপকারী হইতে পারে। রোগের পরিমাণ দেখাইয়া দেওয়া আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য নহে। আমি গেঁটেবাতকে একটি রোগ বলিয়া মনে করি না, কিন্তু মনুষ্য সমাজের বাত প্রকৃতির একপ্রকার লক্ষণসমষ্টি বলিয়া মনে করি,ইহা একপ্রকার গেঁটেবাত প্রকৃতির বিরাট লক্ষণসমষ্টি, একপ্রকার সন্ধিগুলিকে বর্ধিত করিবার প্রবণতা, মূত্রে একপ্রকার গেঁটেবাতজ তলানি সঞ্চয়। তথাকথিত লিথিমিয়া (মূত্রে লিথিক এসিড সঞ্চয়) রোগেও একপ্রকার গেঁটেবাতজ অবস্থা। শরীর বিধানের গেঁটেবাত অবস্থা একটি বাহ্যিক এবং আপাতকারণ, প্রকৃত কারণ, ধাতুদোষের মধ্যে নিহিত। সুতরাং আমি যখন গেঁটেবাতের কথা বলি, তখন আমি একটি রোগের নাম মাত্র বুঝাই না, কিন্তু একপ্রকার বিশেষ লক্ষণ-বিকাশকে বুঝাই, যাহা বড় বড় সহরে বিশেষভাবে দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু পল্লীগ্রামে কম দেখা যায়, কারণ সেখানে লোকেরা গোলাবাড়ীতে বাস করে, যথেষ্ট পরিশ্রম করে এবং পুষ্টিকর খাদ্য খায় ও গৃহমধ্যে আবদ্ধ থাকে না। উহা মদ্যপানহেতু দেখা দেয় বলিয়া মনে হয়। যখনই আমি রোগীকে বলি যে, লক্ষণগুলি কতকটা গেঁটেবাত প্রকৃতির বলিয়া মনে হইতেছে, অমনি তাহারা উত্তর দেয় “আমি ত মদ্যপানে অভ্যস্ত নই, আমি ত বড়লোকের ন্যায় জীবনযাপন করি না।” ঐরূপ অবস্থায় অবশ্যই গেঁটেবাত প্রবণতা উপস্থিত হয়।
‘ব্রায়োনিয়া’ ও ‘জেলসিমিয়ামে’র ন্যায় যন্ত্রণাকর ব্যথা। চক্ষুগোলকের স্পর্শে অত্যনুভূতিযুক্ত। চাপে বেদনান্বিত থাকে এবং মনে হয়, যেন তাহার চোখে কেহ আঘাত করিয়াছে, চক্ষে ক্ষতবৎ, থেঁৎলানবৎ বেদনা। প্রতিটি হাড়ের কনকনারির সহিত সর্দি।
পিত্তাধিক্যের আক্রমণ হইলে উদরাময় নিবারিত হইতে পারে। প্রচুর সবজে নিঃস্রাব, সবুজবৰ্ণ তরল বা অর্ধ-তরল মল, কিন্তু কিছুদিন ধরিয়া আক্রমণটি চলিবার পর, পরিশেষে অন্ত্রাদি একেবারে প্রবলবেগে খালি হইয়া যায় এবং এই লক্ষণ চলিয়া গিয়া দ্বিতীয় অবস্থাটি উপস্থিত হয়, তখন কোষ্ঠবদ্ধতা এবং একপ্রকার হাল্কা রংয়ের মল বা পিত্তশূন্য মলত্যাগ হইতে থাকে।
Boneset-য়ে একপ্রকার শুষ্ক, খকখকে, কাশি আসে, তাহাতে সারা দেহ ঝাঁকাইয়া উঠে, মনে হয়, যেন তাহার শরীর ভাঙ্গিয়া যাইবে; তাহার শরীর এতই বেদনাযুক্ত থাকে যে, সে সঞ্চালনে বড়ই বিচলিত হইয়া পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাস পথে ও বায়ুনলীতে অত্যন্ত যাতনা থাকে আমরা ক্যাপিলারী ব্রঙ্কাইটিস রোগে একপ্রকার ব্রায়োনিয়া ও ফসফরাস সদৃশ কাশি পাই, উহাতে সমস্ত দেহ কম্পিত হইয়া উঠে। রোগী ‘নাক্স ভমিকা’র ন্যায় ঠান্ডা হাওয়ায় অত্যন্ত স্পর্শদ্বেষযুক্ত থাকে। নাক্স ভমিকাতেও যেন হাড় ভাঙ্গিয়া যাইবে, এরূপ কনকনানি আছে, সে ঘরটি গরম হওয়া চাহে, গরম বস্ত্রাদি চায়, তাহাতে উপশম বোধ করে, আচ্ছাদনটি সামান্য মাত্র সরাইলে, তাহার শীতশীতভাব বাড়িয়া যায়। ইহা ইউপেটোরিয়ামেও আছে। সুতরাং ঔষধ দুইটিও খুব সদৃশ হয়। কিন্তু নাক্স ভমিকায় আমরা পাই ভয়ানক ক্রোধপূর্ণ মেজাজ আর ইউপেটোরিয়ামে থাকে অভিভূতকর বিষাদভাব। নাক্স ভমিকা’য় মরিবার কথা বেশী কিছু বলে না, সে এত ক্রোধান্বিত থাকে যে, পরলোকের কথা চিন্তাই করে না, কিন্তু ইউপেটোরিয়ামে ঐরূপ না হইয়া রোগী বিষন্নতায় পূর্ণ থাকে।
এই ঔষধে গৌণভাবে উপস্থিত হয়, এরূপ অন্যান্য অবস্থাও আছে। ম্যালেরিয়া আক্রমণের পর এবং গেঁটেবাত ইত্যাদিতে, নিম্নাঙ্গগুলির স্ফীতি, শোথজনিত স্ফীতি, দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া জ্বর দীর্ঘকাল স্থায়ী হইলে নিম্নাঙ্গের স্ফীতি দেখা দেওয়া অসাধারণ কিছু নয়। এইরূপ দীর্ঘকাল স্থায়ী ম্যালেরিয়ায় ইউপেটোরিয়াম ‘নেট্রাম মিউর’, ‘চায়না’ ও ‘আর্সেনিকামের সহিত প্রবলভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। লক্ষণগুলির অধিকাংশই যখন চলিয়া যায় এবং একপ্রকার নিরক্ততা ও নিম্নাঙ্গের শোথ অবস্থা থাকিয়া যায় তখন এইরূপ কুচিকিৎসিত রোগীর যে কোন ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে, তাহা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন; তখন হোমিওপ্যাথকে যে নীতি অবলম্বন করিতে হইবে, তাহা হইল, রোগীর সবিরাম জ্বরের সময়ে, বেশী ঔষধাদি প্রয়োগের পূর্বে যে-লক্ষণগুলি ছিল, তাহা নির্ণয় করা। তারপর, এখন যখন হস্ত-পদাদির স্ফীতি রহিয়াছে, তখনও যদি দেখিতে পাও গোড়ার দিকে রোগীর ইউপেটোরিয়ামের প্রয়োজন ছিল, তাহা হইলে। পেটোরিয়ামই হস্ত-পদাদির শোথ আরোগ্য করিবে। ইহা হয়ত শীতকে ফিরাইয়া আনিবে, যা হয়ত এমন একটি সুশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করিবে যে, তুমি ঔষধ ব্যবস্থা করিতে পারিবে। যদি গোড়ার দিকে; তাহার আর্সেনিকামের প্রয়োজন থাকিয়া থাকে, তবে উহাতেই শীত ফিরিয়া আসিবে, রোগীকে ঠিক পথে আনিয়া, তাহার লক্ষণগুলি আরোগ্য করিবে। ঝঞ্ঝাটটি এই যে, লক্ষণগুলি চাপা পড়িয়াছিল, আরোগ্য হয় নাই। সুতরাং তাহার শীতের সময় যে-ঔষধটির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দেওয়া হয় নাই তাহাই এখনও তাহার প্রয়োজনে আসিবে। এইবার পায়ের পাতার ও গুলফ সন্ধির শোথের জন্য, এবং বাতজ স্ফীতির জন্য ইউপেটোরিয়ামের কথা চিন্তা কর। গেঁটেবাতজনিত স্ফীতিমাত্রেই প্রাদাহিক প্রকৃতির। সাধারণতঃ ইহা গ্রন্থিস্ফীতির সহিত সম্বন্ধযুক্ত এবং এক্ষেত্রেও ইউপেটোরিয়াম ‘আর্সেনিকের সহিত তুলনীয়। হাঁটুর গেঁটেবাতজপ্রদাহ। মনে রাখিও তোমরা এই ঔষধের আগাগোড়া হাড়ের ব্যথার কথা পড়িয়াছ।
ইহা বাস্তবিকই অদ্ভুত যে; ঔষধগুলি নির্ভুলভাবে ঠিক সময়টিতে ঘুরিয়া আসে (অর্থাৎ প্রযোজ্য হয়)। রোগগুলি সম্বন্ধেও ঐ একই কথা, আমরা দেখি যে, উহারাও অদ্ভুতভাবে নির্দিষ্ট বৃত্তাকারে, নির্দিষ্টকাল ব্যবধানে উপস্থিত হয়।
(Eupatorium, from the surname Eupator of king Mithridates (d, 63 B.C.), who was so named because he happened to have a noble father. Perfoliatum or distinguished by the perfoliate character of its leaves (where the stem seems to pass through the leaf), each pair of which are at right angles to those immediately above or below.)
অপর নাম – বোন-সেট (Bone-set), এগু উইড (Ague weed)
ইহা কম্পোজিটী জাতীয় উদ্ভিদ। এর মুকুলিত ও সরল অবস্থায় এ থেকে অরিষ্ট তৈরী করা হয়।
ইউপেটোরিয়াম পারফোলিয়েটামের — মূলকথা
১। চক্ষুগোলকের যাতনাকর টাটানো ব্যথা; নাসিকার সর্দিস্রাব (coryza); প্রত্যেকটি হাড়ে কামড়ানি ব্যথা; বহু ব্যাপক ইনফ্লুয়েঞ্জার অবসাদক আক্রমণ (la grippe)।
২। গভীর তীব্র বেদনা; বোধ হয় যেন হাড়ের মধ্যে বেদনা হচ্ছে। এর সঙ্গে পিঠে, হাতে, মণিবন্ধে ও পাদুটিতে টাটানি ব্যথা ও থেঁৎলে যাওয়ার ন্যায় বেদনা (bruised feeling)।
৩। জ্বরের শীত ও উত্তাপের মধ্যবর্তীকালে পিত্তবমন; প্রাতে ৭টা থেকে
৯টার মধ্যে শীত বোধ হয়।
৪। কাশবার সময় বক্ষঃস্থলে স্পর্শদ্বেশ বা টাটানি অনুভব সহকারে প্রাতঃকালে স্বরভঙ্গ; রোগী কাশবার সময় বক্ষঃস্থল হাত দিয়ে চেপে ধরে।
ইউপেটোরিয়াম পারফোলিয়েটাম– একটি আলোচনা
আর্নিকা সম্বন্ধে লিখবার সময় আমি কয়েকটি ঔষধের তুলনা করেছিলাম, যাদের থেঁৎলে যাওয়ার ন্যায় বেদনার অনুভূতি আছে। সেখানে এই ঔষধটির কথাও থাকতে পারে, কারণ এতেও “থেঁৎলে যাওয়ার ন্যায় বেদনা, সারা দেহ যেন ভেঙ্গে পড়ছে”, এরূপ অনুভূতি আছে (আর্নিকা, বেলিসপার, পাইরোজেন)।
* ইউপেটোরিয়ামে কামড়ানির সঙ্গে যেন হাড়ের মধ্যে গভীরস্থানে বেদনা এরূপ বোধ থাকে।
আমরা উদাহরণ স্বরূপ এখানে কতকগুলি লক্ষণ উদ্ধৃত করছি –
ক) অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এবং পৃষ্ঠে তীব্র কামড়ানি ব্যথা যেন হাড়গুলি ভেঙ্গে গেছে।
খ) হাতপায়ের হাড়ের মধ্যে কামড়ানি সহ মাংসের মধ্যে টাটানি, হাড়ের মধ্যে টাটানি।
গ) বাহু ও বাহুর (forearm) ক্ষততা ও কামড়ানি; দুই মণিবন্ধে যাতনাদায়ক টাটানি যেন ঔণ্ডলি ভেঙ্গে গেছে বা সন্ধিচ্যুত হয়েছে।
ঘ) নিম্নাঙ্গে টাটানি ও কামড়ানি; আড়ষ্টতা, উঠে বসতে গেলে অবসন্নতা ও সৰ্বাঙ্গীন টাটানি ব্যথা।
ঙ) সৰ্বাঙ্গীন ক্ষততা বোধ ও কামড়ানি, পায়ের ডিম ও পায়ে যেন আঘাত পেয়েছে এরূপ বেদনা।
চ) হাড়ের মধ্যে কামড়ানি সহ কাতর শব্দ।
এইগুলি ইউপেটোরিয়ামের লক্ষণ। ইনফ্লুয়েঞ্জা, পৈত্তিক বা সবিরাম জ্বর, ব্রঙ্কাইটিস, বিশেষতঃ বৃদ্ধদের ব্রঙ্কাইটিস ও অন্যান্য বহুরোগেও এই লক্ষণগুলি দেখতে পাওয়া যায়।
তাছাড়া এক প্রকার বহুব্যাপক সবিরাম জ্বরের প্রাদুর্ভাবকালে হাড়গুলি যেন ভেঙ্গে গেছে এরূপ দারুণ অবিরাম বেদনা (aching) বর্তমান ছিল এবং এই বহুব্যাপক আকারের জ্বরকে হাড়-ভাঙ্গা জ্বর বা ব্রেক-বোন ফিভার বলা হত। এই ঔষধে সেই জ্বর আরোগ্য হয়েছিল। তবে এই ঔষধের আরোগ্যকর গুণ দৈবাৎ আবিস্কৃত হয়েছিল, কিন্তু পরে বহু পরীক্ষা ও রোগীদেহে ব্যবহার থেকে এর হেমিওপ্যাথিত্ব ভালভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শোথরোগে এপিস সম্বন্ধে ও এরূপ হয়েছিল।
সবিরাম জ্বরে ইউপেটোরিয়াম অতিশয় ফলপ্রদ। এর এই রোগ সারানো ছাড়া আর কোন আরোগ্যকর গুণ না থাকলেও কেবল এইজন্যই ইহা অতীব মূল্যবান ঔষধ। অ্যালোপ্যাথেরা যে জ্বরে তাদের ব্রহ্মাস্ত্র কুইনাইন প্রয়োগ করে (একপ্রকার সবিরাম জ্বরে) কিছুই করতে পারেনি। সেই জ্বরে ইউপেটোরিয়ামে রোগ আরোগ্য প্রাপ্ত হয়।
* নিম্নলিখিত তিনটি বিশেষ লক্ষণানুসারে ইহা জ্বরে উপযোগী হয়ে থাকে।
ক) শীতের সময় প্রাতঃ ৭টা থেকে ৯টা।
খ) শীতের পূর্বে হাড়ের মধ্যে দারুণ কামড়ানি।
গ) শীত ও উত্তাপের মধ্যবর্তী সময়ে পিত্তবমন।
অবশ্য ইউপেটোরিয়াম রোগীর আরও অন্যান্য লক্ষণ থাকতে পারে। কিন্তু এই তিনটিই নিশ্চিত পরিচালক এবং বহু প্রকৃত আরোগ্য দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছে।
২। এই ঔষধটি আবার শ্বাসযন্ত্রের রোগেও উপযোগী। আজকাল যাকে লা গ্রিপ (ইনফ্লুয়েঞ্জা) বলা হয় তাতে আমার হাতে ইহা বিশেষ মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছে। “সৰ্ব্ব শরীরে যেন হাড়ের মধ্যে কামড়ানি” এটিই এর পরিচালক লক্ষণ।
৩। প্রাতঃকালে স্বরভঙ্গ কষ্টিকামের ন্যায় ইউপেটোরিয়ামেরও লক্ষণ। কষ্টিকামে বক্ষঃস্থলে অধিক জ্বালা ও অবদবণ (rawness) থাকে, ইউপেটোরিয়ামের বুকে টাটানো ব্যথা থাকে।
র্যানানকিউলাস বাল্বে হাঁটতে, ঘুরতে-ফিরতে, স্পর্শে ও ঋতু পরিবর্তনে বুকে বেদনা জন্মে; কাশবার সময় এতই বেদনা লাগে যে, রোগী হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে রাখে (ব্রাই, ড্রসেরা, ক্রিয়ে, জোট, নেট্রাম সালফ, সিপিয়া)। উভয় ঔষধেই, বিশেষতঃ ইনফ্লুয়েঞ্জায় হাড়ের কামড়ানি ব্যথা থাকে, কিন্তু ইউপেটোরিয়ামেই উহার অত্যন্ত অধিক্য দৃষ্ট হয়। উপরোক্ত দুটি ঔষধের কোনটিরই দ্বারা স্বরভঙ্গ আরোগ্য না হলে সালফারে উপকার দর্শে। (সালফার অনুপূরক)।
মোটের উপর পূর্বোক্ত বিশেষ লক্ষণগুলি বিদ্যমান থাকলে বহুরোগেই ইউপেটোরিয়াম ব্যবহার্য। ইউপেটোরিয়াম জীর্ণদেহ বৃদ্ধদের ও মদ্যপায়ীদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। ব্রায়োনিয়া এর ঘনিষ্ঠ সদৃশ ঔষধ। ব্রায়োনিয়ায় রোগীর বিমুক্তভাবে ঘৰ্ম্ম নিঃসৃত হয় এবং বেদনায় রোগী স্থির হয়ে থাকে, ইউপেটোরিয়ামে স্বল্প ঘৰ্ম্মম্রাব ও বেদনায় রোগীর অস্থিরতা জন্মে।